বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল পাস করেছে জাতীয় সংসদ
DESK NEWS:-বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল পাস করেছে জাতীয় সংসদ। আইনের আটটি ধারার সাংবাদিকদের আপত্তি ছিল। কিন্তু সেগুলোতে কার্যত কোনো দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। তবে, কয়েকজন বিরোধীদলীয় সদস্য বিলটি পাসের বিরোধিতা করেছেন। বুধবার স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী সভাপতিত্বের অধিবেশনে বিলটি পাস হয়।
আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলের ৩২ ধারায় অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট প্রয়োগ করে সরকারি কোনো কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক্স মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যকে (‘তথ্য পাচারের’) অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই অপরাধ সংঘটন ও সংঘটনে সহায়তার দায়ে ১৪ বছর কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। যদি কেউ একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার সংঘটিত করেন, তাহলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আইনে পুলিশকে বিনা ওয়ারেন্টে তল্লাশি ও গ্রেফতারের পাশাপাশি ক্ষতিকর তথ্য-উপাত্ত ব্লক বা অপসারণের বিধানও রাখা হয়েছে। এছাড়া এই আইনের অধীনে কৃত সব কাজকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বিলটি পাস করার প্রস্তাব করেন। এর আগে বিলের ওপর আনীত একটি সংশোধনী গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিলের মহাপরিচালকের অনুমোদন ছাড়াই পুলিশ যেকোনো স্থানে প্রবেশ, তল্লাশি করতে পারবে এবং বাধাপ্রাপ্ত হলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে। অন্যান্য সংশোধনীসহ জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে প্রেরণের প্রস্তাবগুলো কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।
বিলের ৮ ধারায় বলা হয়েছে, জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিলের মহাপরিচালকের নিজ অধিক্ষেত্রভুক্ত কোনো বিষয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করলে তিনি উক্ত তথ্য-উপাত্ত অপসারণ, ক্ষেত্রমতে ব্লক করার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবেন। একইধারায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় মহাপরিচালকের মাধ্যমে একইভাবে তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা বøক করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আইনের এ ধারায় সরকারকে অবহিত করে বিটিআরসিকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাপ্ত অনুরোধ কার্য করার সক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
বিলে ২১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা তাতে মদদ দেন, তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। উক্ত একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার সংঘটিত করেন, তাহলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা তিন কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
২৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে (ক) ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলে জানা থাকা সত্তে¡ও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্ত বা হেয় প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন বা (খ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণœ করার বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর বা তদুদ্দেশ্যে অপপ্রচার বা মিথ্যা বলে জানা থাকা সত্তে¡ও কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে তিনি ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। উক্ত একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার সংঘটিত করেন, তাহলে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভ‚তিতে আঘাত করার বা উসকানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্যকোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন, যা ধর্মীয় অনুভ‚তি বা মূল্যবোধে আঘাত করে তাহলে তিনি ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার সংঘটিত করেন, তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
২৯ ধারায় বলা হয়, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্যকোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে প্যানাল কোডের ৪৯৯ ধারায় বর্ণিত মানহানিকর কোনো তথ্য প্রচার বা প্রকাশ করেন, তাহলে তিনি ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার সংঘটিত করেন, তাহলে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রæতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটানোর উপক্রম হয়, তাহলে তিনি ৭ বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার সংঘটিত করেন, তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
৩২ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি (অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট ১৯২৩-এর আওতাভুক্ত) কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করতে সহায়তা করেন তাহলে তিনি ১৪ বছর কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। যদি একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার সংঘটিত করেন, তাহলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ৪৩ ধারায় বলা পুলিশকে গ্রেফতারি পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, মালামাল জব্দ ও গ্রেফতারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিলের মহাপরিচালকের অনুমোদন ছাড়াই পুলিশ যেকোনো স্থানে প্রবেশ, তল্লাশি করতে পারবে এবং বাধাপ্রাপ্ত হলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে। কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম ও নেটওয়ার্কসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ও দলিলাদি জব্দ ও উক্ত ব্যক্তি গ্রেফতার করতে পারবে। তবে তল্লাশি সম্পন্ন করার পর এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালকে প্রতিবেদন দিতে হবে।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সংবলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ‘রূপকল্প ২০২১: ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণেও লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সর্বোচ্চ নিরাপদ ব্যবহার আবশ্যক। বিশে^ তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে এর সুফলের পাশাপাশি অপপ্রয়োগও বৃদ্ধি পেয়েছে। সাইবার অপরাধের মাত্রাও বাড়ছে। তাই জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং ডিজিটাল অপরাধসমুহের প্রতিকার, প্রতিরোধ, দমন, শনাক্তকরাণ, তদন্ত এবং বিচারের উদ্দেশ্য আইন প্রণয়ন আবশ্যক।
সমালোচনায় বিরোধী দলের এমপিরা
ফখরুল ইমাম বলেন, এই বিলে অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট যুক্ত করা অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রস্তাবিত আইনের ৩২ ধারা প্রয়োগের ফলে তথ্য অধিকার অধিকার ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ফলে দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধের অধিকতর বিস্তার ঘটবে। তাছাড়া ধারাটি অনুসন্ধান সাংবাদিকতা যুক্ত এবং যেকোনো গবেষণামূলক কর্মকাণ্ড প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ কাজ করবে। তিনি বলে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সংবিধানের মূল চেতনার বিশেষ করে মুক্তচিন্তা, বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমে স্বাধীনতা ও বিকাশে পথ রুদ্ধ করবে। ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতা বোধ সৃষ্টি করবে। এজন্য বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা উচিত ছিল।
তিনি বলেন, অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট প্রয়োগ, ১৯২৩-এর মতো আইনের বিতর্কিত ধারা এই আইনের সঙ্গে যুক্ত করা কতটুকু প্রাসঙ্গিক কতটুকু না তা চিন্তা করা খুবই গুরুত্ব বলে আমি মনে করি। ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি দুর্নীতি ও সুশাসন নিশ্চিতে যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে প্রস্তাবিত আইনটি সে ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করবে।
কুমিল্লা-৮ থেকে নির্বাচিত জাতীয় পার্টির নুরুল ইসলাম মিলন বলেন, গণমাধ্যমের অধিকার ও তথ্য পাওয়ার অধিকার এই আইনে নিশ্চিত করা হয়নি। স্বাধীনভাবে মতামতের যে অধিকারÑ তা এই আইনে নিশ্চিত করেনি। সংরক্ষিত নারী আসনের রওশন আরা মান্নান বলেন, ডিজিটাল আইন প্রণয়নের দরকার আছে। কিন্তু মিডিয়া ও সাংবাদিকের মতে এই আইন সংবিধান বিরোধী। তাই সরকারের দরকার ছিল বিলটি আনার আগে জনমত যাচাই করা। সংরক্ষিত নারী আসনের নূরে হাসনাত চৌধুরী লিলি বলেন, আমি জানি বিলটি কণ্ঠভোটের মাধ্যমে পাস করে নিয়ে যাবেন। ডিজিটাল আইনের মাধ্যমে অপরাধ দ‚র করা খুব কঠিন।
শামীম হায়দার পাটুয়ারী বলেন, আমাদের সংবিধানের ৩৯ ধারায় সংবাদ মাধ্যম ও মুক্তচিন্তার অধিকার দেয়া হয়েছে। চিন্তার স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সরকার এমন কোনো আইন পরিচালনা করবে না যা স্বাধীন চিন্তায় কোনো ধরনের চাপ অনুভব করবে। কিন্তু এই আইনটি সংবিধান থেকে অনেক দূর চলে গেছে। ৫৭ ধারা করার পর সারা বাংলাদেশ এর অপব্যহার দেখেছি। শেষ পর্যন্ত পুলিশ বলতে বাধ্য হল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি ছাড়া কোনো মামলা করতে পারবেন না। সেই ৫৭ ধারার যে ভীতি এই আইনে আরো বেশি। সেই ৫৭ ধারার বিষয়গুলো এই আইনের বিভিন্ন ধারা বিস্তারিত ভাবে আনা হয়েছে। এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনেক বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
No comments