চিকিৎসার কথা বলে বাবার সম্পত্তি লিখে নিয়েছে ছেলে
তিন বছর ধরে ঘর ছাড়া বৃদ্ধা মা। অসুস্থ বাবার চিকিৎসার জন্য তার সম্পত্তি লিখে নিলেও চিকিৎসা হচ্ছে না তার। মাথা ও কপালে দগদগে ঘা নিয়ে বাবা ইউনুছ গাজী প্রতিনিয়ত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হলেও জমি বিক্রির টাকা আত্মসাৎ করে অসুস্থ বাবার চিকিৎসা হচ্ছে এখন গ্রাম্য ডাক্তার ও ফকিরের ঝাড়ফুঁকে। অথচ অঢেল বিত্ত-বৈভবের মালিক ইউনুছ গাজী জীবনের শেষ লগ্নে এখন স্ত্রী রাবেয়া বেগমকেও পাশে পাচ্ছেন না। কারণ সম্পত্তির জন্য মাকেও ঘর থেকে বের করে দিয়েছে ছেলে মামুন গাজী। এ কারণে বৃদ্ধা অসুস্থ মাকে তিন বছর ধরে রাত কাটাতে হচ্ছে কখনও মেয়ের বাড়ি, কখনও আত্মীয়ের বাড়ি। জীবনের শেষ লগ্নে স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকবেন বলে মা নিজের পৈত্রিক সম্পত্তির অংশ বিক্রি করে ছেলের সুখের জন্য করেছিলেন দোতলা পাকা ঘর। অথচ তাকে এখন রাত কাটাতে অন্যের ঘরে। দু,মুঠো ভাতের জন্য তাকে ঘুরতে হচ্ছে পথে পথে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের মিঠাগঞ্জ গ্রামে বাবা-মায়ের উপর ছেলে ও ছেলের বউয়ের বর্বর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। বাধ্য হয়ে নিজের ও অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা, সম্পত্তি রক্ষা এবং ভরন পোষণের জন্য কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেছেন রাবেয়া বেগম। বিচার চেয়েছেন ছেলের অমানুষিক নির্যাতনের।
দুই ছেলে,দুই মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে সুখের সংসারই ছিলো রাবেয়া বেগমের। বয়স সত্তর ছুইছুই এ বৃদ্ধার জীবনে হঠাৎ ঝড় আসে কয়েক বছর আগে বড় ছেলে ফেরদৌস ও মেয়ে আখিনুর হঠাৎ মৃত্যু হলে। সন্তান হারানোর কষ্টে ষ্ট্রোক করে অসুস্থ হয়ে পড়ে রাবেয়ার স্বামী ইউনুছ গাজী। অসুস্থ স্বামী ও বেঁচে থাকা ছোট ছেলের মুখ চেয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে নিজের পৈত্রিক সম্পত্তির অংশ বিক্রি করে ছোঠ ছেলে মামুনের জন্য দোতালা পাকা ঘর তুলে দেয়। ছেলেকে বিয়ে করিয়ে পুত্রবধু ঘরে নিয়ে আসে। বিয়ের পর ছেলের সুখের জীবন শুরু হলেও অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে দুঃখ-কষ্টের জীবন ক্রমশ আলীঙ্গন করতে থাকে রাবেয়া বেগমকে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সবুজে ঘেরা যে সুখের ঘর তৈরি করেছিলো জীবনের শেষ লগ্নে স্বামী-সন্তানকে নিয়ে থাকার জন্য, সে ঘর তাকে ছাড়তে হয় ছেলের লোভের কারনে। ছেলে ও পুত্রবধুর ক্রমশ মানসিক নির্যাতনে রাবেয়া বেগম স্বামীকে নিয়ে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়। আশ্রয় হয় নিজ বসত ঘর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরের গ্রামের মেয়ে ফরিদা বেগমের ঘরে।
রাবেয়া বেগম বলেন, ছেলে মামুন সম্পত্তির জন্য তার অসুস্থ জন্মদাতা পিতাকে চাপ দিতে থাকে এবং জমি লিখে দিলে তার চিকিৎসা করাবে বলে আশ্বাস দেয়। ঘর ছাড়া হয়ে নয় মাস মেয়ের ঘরে থাকার পর গত ২০দিন আগে পিতাকে ফুসলিয়ে নিজ ঘরে নিয়ে যায় মামুন। সেখান থেকে কলাপাড়ায় চিকিৎসার কথা বলে নিয়ে গিয়ে তার সম্পত্তি লিখে নেয়।
রাবেয়া বেগম আরও জানায়, সে নিজে অসুস্থ্য। মেয়ে ও জামাই তাকে বরিশাল নিয়ে ডাক্তার দেখায়। ডাক্তাররা তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে বললেও সে টাকার ভর্তি হতে পারেন নি। এ কারণে চিকিৎসা না করিয়ে আবার কলাপাড়া চলে আসেন। কলাপাড়ায় এসে এক সপ্তাহ ছেলের ঘরে থাকলেও তাকে ভাত খেতে হয়েছে অন্যের ঘরে, ঘুমাতে হয়েছে প্রতিবেশীর ঘরে। এমনকি তাকে ভাত খেতে হলে মেয়ের বাড়ি থেকে চাল নিয়ে যেতে বলে ছেলে মামুন। সে তার চিকিৎসার জন্য ছেলের কাছে টাকা চাইলেও তাকে এক টাকাও দেয়া হবে না বলে জানিয়ে দেয় চেলে মামুন। অথচ তার স্বামীর সম্পত্তি বিক্রি করে নিজের জন্য মোটরসাইকেল ক্রয় করলেও মায়ের চিকিৎসা করাতে পারবে না বলে তাড়িয়ে দেয় ঘর থেকে।
রাবেয়া বেগমের দেবর ইসমাইল গাজী বলেন, তার ভাই অসুস্থ্য। কপাল ও মাথায় ঘা, কিন্তু তার কোন চিকিৎসা করাচ্ছে না ভাইয়ের ছেলে মামুন। অথচ বাবার চিকিৎসার কথা বলে সে তার নামের জমি লিখে নিয়েছে।
রাবেয়া বেগমের দেবরের ছেলে মিজানুর রহমান বলেন, তার চাচীকে তিন বছর ধরে খেতে দেয় না মামুন। মেয়ের বাসায় আশ্রয় না হলে হয়তো কবেই মরে যেত। অথচ চাচার সব সম্পত্তি লিখে নিয়ে এখন চাচাকেও চিকিৎসা করাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে রাবেয়া বেগমের পুত্রবধু খাদিজা বেগম বলেন, তিনি তার শ্বাশুড়ীর সাথে কোন খারাপ আচরণ কিংবা ঘর থেকে তাড়িয়েও দেন নি। সে নিজ ইচ্ছায় মেয়ে বাড়ি গেছে। তবে শ্বশুড়ের সম্পত্তি লিখে নিলেও তার স্বামী মামুন গাজী শ্বশুরের চিকিৎসা করাচ্ছেন বলে জানালেন।
রাবেয়া বেগমের মেয়ে খাদিজা বেগম বেগম বলেন, তার মা ও বাবা তার কাছেই থাকতো। কিন্তু ২০দিন আগে হঠাৎ তার বাসা থেকে অসুস্থ বাবাকে চিকিৎসার কথা বলে বাসায় নিয়ে যায় ভাই মামুন। কিন্তু মাকে নেয়নি। পড়ে জানতে পারলাম তার বাবার সম্পত্তি লিখে নিয়েছে সে। অথচ তার কোন চিকিৎসা হচ্ছে না।
এদিকে ছেলের অত্যাচার সইতে না পেরে নিজের ও স্বামীর জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে রাবেয়া বেগম ছেলের বিরুদ্ধে কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবর অভিযোগ দিলে তেলেবেগুনে জ¦লে ওঠে মামুন। তার বাবা তাকে সম্পত্তি লিখে দিয়েছে এবং এই সম্পত্তি দিয়ে সে কী করবেন তা একান্তই তার ইচ্ছে বলে জানায় মামুন গাজী।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে এসে মামুন তার মা-বাবাকে দেখবেন এবং ভরন পোষন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করাবেন এমন মুচলেকা দিয়ে অফিস থেকে বের হলেও মাকে রাস্তায় ফেলেই বাসায় চলে যায় মামুন। মায়ের উপর সন্তানের নির্যাতনের খবর পেয়ে কলাপাড়া উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ঘটনাস্থলে ছুটে গেলে তার সামনেই অসুস্থ বাবার সাথে অশালীন আচরণ করে মামুন। ষ্ট্রোক করে সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেও কড়া ধমকের সুরে তাকে হেঁটে উঠানে ঘুরতে বলে মামুন। অথচ সে নিজ ইচ্ছায় এক পা চলতে পারছে না।
এ ব্যাপারে মামুন গাজী জানায়, তার বাবা তাকে জমি লিখে দিয়েছে। তার বাবার চিকিৎসা সে বালিয়াতলী গ্রামের এক গ্রাম্য ডাক্তার দিয়ে করিয়েছেন। এতে সুস্থ্য হয়নি। এখন তার উপর উপরি( গ্রাম্য কুসংস্কার জ¦ীন,ভূত) ভর করেছে। গতকাল এক হুজুরকে খবর দিয়েছেন।
কিন্তু তার মাকে তিন বছর ধরে কেন খেতে দিচ্ছেন না এবং কেন ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, বাবার সম্পতি কীভাবে লিখে নিলেন এ বিষয়টি জানতে চাইলে বলেন, লিখে নিয়েছি তাতে কী হয়েছে, বাবার চিকিৎসা তো করাচ্ছি বলে জানান।
মিঠাগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান কাজী হেমায়েত উদ্দিন হিরন জানান, বাবার চিকিৎসার কথা বলে মামুন তার সম্পত্তি লিখে নিয়ে এখন কোন চিকিৎসা করাচ্ছে না। মাকে তো বের করে দিয়েছে তিন বছর আগে। তারা স্থানীয়ভাবে সমঝোতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।
কলাপাড়া উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শাহীনা পারভীন সীমা বলেন, বাবা-মায়ের প্রতি কোন সন্তান এভাবে ব্যবহার করতে পারে তা আজ স্বচক্ষে দেখলাম। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এ ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে।
মিঠাগঞ্জের একাধিক গ্রামবাসী ও রাবেয়া বেগমের প্রতিবেশীরা জানান, নিজে ভাতের ফেন খেয়ে, সহায় সম্পত্তি খুইয়ে ছেলে-মেয়েদের বড় করেছেন রাবেয়া বেগম। অথচ তিন বছর ধরে সে নিজ ঘরে থাকতে পারছে না। মামুন তার মাকে ঘরে তো তুলছেনই না বরং বাবার সম্পত্তিও তার শ্বশুড়ের সহায়তায় লিখে নিয়েছে। এখন কোথায় যাবে এ বৃদ্ধা ও বৃদ্ধ। তারা দু’জনেই অসুস্থ্য।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মুনিবুর রহমান বলেন, এক মা তার কাছে ছেলের বিরুদ্ধে ভরন পোষন না দেয়া ও ঘর থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ করেছেন। সন্তানের বিরুদ্ধে স্বামীর সম্পত্তি লিখে নেয়ারও অভিযোগ করেন। বিষয়টি জানার পর ছেলেকে ডেকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে মাকে নিজ বাসায় তুলে নেয়ার জন্য বলেন এবং তাদের চিকিৎসা করাতে বলেন। কিন্তু ছেলে মাকে অফিসের সামনে ফেলে রেখে গেছে বলে খবর পেয়েছেন। ছেলে যদি তার মাকে ঘরে তুলে না নেয় তাহলে প্রশাসন অসুস্থ বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার চিকিৎসার উদ্যেগ নেবে। এ ছাড়া আগামী বুধবারের মধ্যে বাবার কাছ থেকে লিখে নেয়া সম্পত্তি ফিরিয়ে না দিলে তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে।
No comments